Monday, October 14, 2013

Travelogue - Beizing by Dr. Nafia Farzana




বেইজিং এ বাজিমাত


ঘুরে বেড়ানোটা নেশার মত। যত ভ্রমণ করা যায় ততই এর চাহিদা ও শখ উত্তরোত্তর যেন বাড়তে থাকে। কিছুদিন আগে একটি ব্লগে একটি ভ্রমণ কাহিনী পড়েছিলাম, তাতে লেখক লিখেছেন “ঘোরাঘুরিটা আমার ইদানিং একটু যেন বেড়ে গেছে। কিছুদিন না ঘুরলেই গা’ টা ম্যাজম্যাজ করতে শুরু করে”। আমার লেখকের মত এতটা বাড়াবাড়ি নেই তবে ভবিষ্যতে হবে না এই মুহূর্তে ঠিক বলা যাচ্ছে না।
হটাৎ করেই আমাদের চীন ভ্রমণের পরিকল্পনাটা তৈরি হয়ে গেলো। দল বেঁধে ঘুরে বেড়নোর একটা আলাদা আনন্দ আছে, কিন্তু দল বাঁধাতেই যত ঝামেলা দেখা দিল। সবারই কিছু না কিছু সমস্যা লেগে আছে। অনেক খুঁজে পেতে একটা ক্ষুদ্র দল তৈরি করা হলো। এবার বাঁধ সাধল ভিসা। চীন দেশের ভিসা প্রাপ্তি বেশ জটিল একটি ব্যাপার। বহু কষ্টে ট্রাভেল এজেন্টের সহায়তায় একটি অদ্ভুত গ্রুপ ভিসা যোগাড় হলো “এ ফোর” সাইজের একটি সাদা কাগজে, পাসপোর্টের কোথাও কোন সীল ছাপর নেই। তাও বাঁচোয়া ভ্রমণের অনুমতিটা পাওয়া গেল, ভিসার মারপ্যাঁচে পড়ে ভ্রমণের আনন্দটাই মাটি হবার জোগাড় হচ্ছিলো। নির্দিষ্ট দিনে “ইস্টার্ন চায়না” বিমানে করে ছুটলাম বেইজিং এর পথে। প্লেন তো না যেন লোকাল বাস, পুরোটা পথ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মোটামুটি জাম ভর্তা বানিয়ে নিয়ে গেল। মনে মনে ভাবছিলাম মেঘের ভেতরও কি খানাখন্দ, speed breaker আছে নাকি?
বেইজিং শহরটি বেশ পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি তাই নেমেই ভালো লেগে গেল শহরটাকে । এক সময়ে ট্রাফিক জ্যাম এর জন্য প্রসিদ্ধ্ব বেইজিং এ প্রচুর সাবওয়ে, স্কাই ট্রেন ও ফ্লাই ওভার তৈরি হওয়ায় যানজট এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। হোটেলে পৌঁছে দেখি লবিতে আমাদের গাইড ভাইজান “রক” সাহেব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। যেমন নাম তেমনি তার দর্শন। পরিচয় পর্ব সেরে দর্শনীয় স্থানগুলোর মোটামুটি একটা বর্ণনা দিলেন এবং সাথে চলা ফেরার সুবিধার জন্য চীন দেশীয় কিছু নিয়ম কানুনও বাতলে দিলেন । প্রথমেই আমরা যাবো ঐতিহাসিক চীনের প্রাচীর দেখতে। কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাপী ভোটাভুটি হয়ে সপ্তাশ্চর্যের যে নতুন তালিকা তৈরি হয়েছে তাতে এর নামটি বাদ পড়েনি আবার UNESCO WORLD HERITAGE এর ৯৮১ দর্শনীয় স্থানের তালিকাতেও এর নাম আছে। সেই ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি এই প্রাচীর এর নাম তাই এটা দেখার আলাদা কৌতূহল আমাদের সবার। আগ্রা গিয়ে তাজমহল না দেখা আর চীন দেশ ঘুরতে এসে প্রাচীর না দেখা সমান গুরুতর অপরাধ আমার মতে। চীনের প্রাচীর এর বিশালত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে মাঝে একটি কথা শুনে ছিলাম যে এই প্রাচীর নাকি চাঁদ থেকেও দেখা যায়। বাড়ী থেকে রওনা দেবার আগে একবার ইন্টারনেট কথাটির সত্যতা একটু যাচাই করে নিলাম। দেখলাম তথ্যটা নিখাদ গুজব ছিল । যাহোক এই প্রাচীর এর বিশালত্ব বর্ণনা করা কঠিন। পাহাড়ের পর পাহাড় জুড়ে দৃষ্টি সীমার বাইরে এর বিস্তৃতি। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মাইল লম্বা এবং চওরায় প্রায় ১০ মিটার এটি । বলা হয় যে সাতটি ঘোড়া পাশাপাশি এই প্রাচীর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০০ বি সি তে এবং পরবর্তি ষোড়শ শতাব্দীতে এসে মিং সাম্রাজ্যের সময় শেষ হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ গুলোর অনুপ্রবেশ থেকে চীনকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন সময়ে এই প্রাচীরের নির্মাণ এবং পুনঃ নির্মাণ চলতে থাকে। ভারতের জয়পুরে এমন একটি প্রাচীর আছে যার নাম “জয়গড় প্রাচীর” যা কিনা জয়গড় দুর্গটিকে ঘিরে তৈরি। এই প্রাচীর টির ব্যাপ্তি চীনের প্রাচীরের মত না হলেও ভারত উপমহাদেশের মুঘল সাম্রাজ্যের অসাধারণ নিদর্শন এই প্রাচীর টি সবাই “জয়পুর” বেড়াতে গেলে দেখে আসবেন।
চৈনিকরা আমাদের বঙ্গদেশীয় শাড়ি, সালওয়ার কামিজ দেখে অভ্যস্ত নয় তা তাদের দৃষ্টি আর আমাদের সাথে ছবি তোলার বহর দেখে বুঝতে পারলাম। কৌতূহল ভরে চাইনিজ ইংরেজি ভাষায় জানতে চাইল কোথা থেকে এসেছি আমরা। ওদের ভাষা খুব যে বুঝতে পারলাম তা না, তবে এটাই জিগ্যেস করছে ধরে নিয়ে বললাম “বাংলাদেশ”। অবাক দৃষ্টি দেখে বুঝলাম বাংলাদেশ চিনতে পারেনি তাই বললাম ভারতের কাছে একটি দেশ। এবার আমার অবাক হবার পালা, হেসে জানাল ভারত কথায় তাও জানেনা। সুদূর মিশরের অলি গলিতে শাহরুখ, সালমানের ছবি দেখেছি। মিশরিদের কে ভারতের কাছে বাংলাদেশ বললেই ওরা বুঝে নিত, অনেকের কাছে তাও বলা লাগত না ।
প্রাচীর দর্শন শেষে রওনা হলাম “পাখির বাসা” নামক Beijing National Stadium দেখতে। এখানে ২০০৮ সালে অলিম্পিক গেম অনুষ্ঠিত হয়। অসাধারণ এই স্টেডিয়ামের নির্মাণ শৈলী। সুইস স্থপতিই “হারজগ” ও “মিউরন” এটির নকশা তৈরি করেন। সমস্ত এলাকা জুড়ে রয়েছে নানা রকম সুভেনির দোকান। আকাশে উড়ছে ৫ থেকে ৬ হাত লম্বা লম্বা ঘুড়ি ,মনে হল যেন মেলা বসেছে। ওয়াটার কিউব হল আরেকটি স্থাপত্য যেখানে অলিম্পক গেম এর সময় swimming competition গুলো হয়েছিল। এখন এর ভিতরে একটি “ওয়াটার ওয়ার্ল্ড” নামক খেলার জায়গা আছে, তবে সময় সল্পতার কারণে এখানে আমাদের ঢোকা হয়নি। আমাদের গাইড আমাদের “চাইনিজ এ্যক্রোবেটিক শো” দেখানের জন্য প্রায় ঊর্ধ্ব শ্বাসে সেই অলিম্পক স্টেডিয়াম থেকে নিয়ে এলো। খুব একটা আগ্রহ পাচ্ছিলাম না এটা দেখার কারণ সেই ছোট বেলা থেকে বিটিভি তে “চাইনিজ এ্যক্রোবেটিক শো ” দেখে দেখে বড় হয়েছি । মনে মনে আমাদের ধারনা বাসায় কিছুটা প্রাকটিস করলে আমরাও দুই একটা খেলা দেখাতে পারব। বেশ বিরক্তি ও ক্লান্তি নিয়ে সো দেখতে ঢুকলাম। সামনা সামনি দেখার আনন্দ যে অন্য রকম তা ঢুকে টের পেলাম। আলোর কারসাজির সাথে চটকদার জামা পরে যখন ওরা বাজনার সাথে সাথে খেলা গুলো দেখাচ্ছিল তখন বেশ ভালোই লাগলো দেখে। আমাদের দেশে দেখেছি একটা গোলকের ভিতর একটা সাইকেল চালনা যাকে “মৃত্যু কুপ” বলা হতো। এবার দেখলাম একটি গোলকের মধ্যে একসাথে ৮টি মটর সাইকেল চালনা । শ্বাসরুদ্ধকর এবং এক কথায় দারুণ!
চীন দেশে বাক স্বাধীনতা একেবারেই নেই। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েব সাইট গুলো যেমন টুইটার, ফেসবুক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এখানে। সেটা আরও টের পেলাম “তিইয়েনানমেন স্কয়ার” এ গিয়ে। ১৯৮৯ সালের চৈনিক বিপ্লবের স্মৃতি স্বরূপ এই জায়গাটির নাম আমরা শুনে এসেছি তাই এই বিষয়ে আমাদের গাইড কে প্রশ্ন করায় দেখলাম একই সাথে খানিকটা বিরক্তি ও ভীতি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল আমরা এখানে স্থাপত্য দেখতে এসেছি, ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে মোটেই আগ্রহী নই, ইতিহাস ইন্টারনেট থেকে বাড়ী গিয়ে পড়ে নেয়া যায়। তার এই রুঢ় আচরণে আমরা খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম কিন্তু পরে জানতে পারি যে সকল দর্শনীয় স্থান ও মার্কেট এলাকায় সরকারের গুপ্তচর থাকে, সরকার বিরোধী যেকোন আচরণে তৎক্ষনাৎ গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তিইয়েনানমেন স্কয়ারের পাশেই রয়েছে ১৪০০ শতাব্দীতে তৈরি মিং সাম্রাজ্যের প্রাসাদ “ forbidden city” । ৯৮০ টি বাড়ী ও ৯৯৯৯ টি কামরা নিয়ে তৈরি এক এলাহি প্রাসাদ । সেই সময়ে সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিষেধ ছিল বলেই এই নাম কিন্তু এখন পযটনের জন্য পুরো প্রাসাদটি খুলে দেয়া হয়েছে । লম্বায় দেড় কিলোমিটার এই প্রাসাদটি হেঁটে দেখতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বয়ঃবৃদ্ধ্বদের ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা।
“Forbidden City” থেকে আমরা চলে এলাম কুমিং লেকের পাড়ে অবস্থিত রাজাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস “Summer Palace” এ। ৮০০ শতাব্দীতে জিন সাম্রাজ্যের সময় তৈরি এই প্রাসাদ । বিশাল এর স্থাপত্য নির্মাণ ।এখানে একটি ৭২৮ মিটার লম্বা একটি কাঠের টানা বারান্দা আছে যা দিয়ে হেঁটে প্রাসাদ থেকে কুমিং লেকের পাশে এসে বসা যায়। বারান্দার ছাদে এবং কাঠের পিলারে আঁকা হাজার বছরের পুরনো নানা রঙের ফ্রেসকো গুলো অসাধারণ এবং এখনো উজ্জ্বল । প্রতিটি দেয়ালচিত্র বর্ণনা করে নান রকমের কল্পকাহিনী ও পৌরাণিক গল্প। কুমিং লেকে নৌবিহারের ব্যবস্থা আছে । ড্রাগন নামক কাল্পনিক প্রাণীটিকে আমরা ভীষণ হিংস্র জানি, কিন্তু চীনাদের কাছে এই ড্রাগন হল সুরক্ষা ও বন্ধুত্বের প্রতীক। তাই তাদের বিভিন্ন জায়গাতে ড্রাগনের ছবি ও মূর্তি আছে। এই কাল্পনিক ড্রাগনের আকৃতির “ড্রাগন বোট” নামক একটি ইঞ্জিন নৌকা দিয়ে মনোরম এই লেকটি তে আমরা ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ।
বেইজিং হল ইলেক্ট্রনিক্সের এবং ঘর সাজানোর নানা শৌখিন জিনিসের স্বর্গরাজ্য। দামাদামি করাটা এখানে রীতিমত একটা শিল্প । এই শিল্পে অদক্ষ হলেই ধরা খেতে হবে অবধারিতভাবে। সাধ্যের মাঝে কিছু সুভ্যনির কিনে ফিরে এলাম হোটেলে। ঘুরে দেখার বাড়তি আনন্দ হল কেনাকাটায়। ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে এই সুভ্যনির আর ছবি গুলো উল্টে পাল্টে দেখে বহুদিন পযন্ত ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিগুলোকে সতেজ রাখা যায়।

The author is a practicing Psychiatrist, she
lives in Dhaka, Bangladesh with her family.



Photo curtesy - Author
Photo index 1) dragon boat in kunming lake, 2)great wall, 3) forbidden city.

No comments:

Post a Comment