Tuesday, September 2, 2014

Travelogue of the month - Bali by Nafia Farzana



দ্বীপ কন্যা বালি


ভারত মহাসাগরে ১৭,০০০ থেকে ১৮,০০০টি ছোট বড় দ্বীপ নিয়ে মোতির মালার মত ইন্দোনেশিয়া রাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ দ্বীপপুঞ্জ । নীল জলরাশির মাঝে পাহাড় আর সবুজে ঘেরা ছোট্ট একটি দ্বীপ কন্যা “বালি” । পর্যটনের পুণ্যভূমি বালিতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ঘুরতে আসে। এখানকার পর্যটকদের মাঝে অস্ট্রেলিয়ান আর চীনারাই বেশী তবে ইদানিং ভারতীয়দের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। অনেকগুলো সমুদ্র সৈকতের মাঝে আমরা “কুটা” সৈকতটিকে বেছে নিলাম থাকার জন্য। কুটা বালির রাজধানী “দেনপাসার” এ অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের খুব কাছে গড়ে ওঠা ছিমছাম একটি সমুদ্র শহর। এখানে হোটেলের জানালা দিয়ে সামনের ভারত মহাসাগরের নীল জলরাশি দেখে চোখটা জুড়িয়ে যায়।
বালি মূলত হিন্দু প্রধান দ্বীপ। এখানে ৯০ শতাংশ অধিবাসী হিন্দু। তাই দ্বীপটির পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনার ক্ষেত্রে নানা রকমের মন্দির উল্লেখযোগ্য । আনাচে কানাচে ছরিয়ে আছে ছোট বড়, একাল সেকালের অনেক অনেক মন্দির। সারা শহর দেবতার নৈবদ্যে দেয়া ফুলের গন্ধে সারাক্ষণ মম করে । কাঠগোলাপ এখানকার জাতীয় ফুল। যেকোনো রেস্তোরাঁ ও হোটেলে গেলে অতিথিদের তারা এই কাঠগোলাপ এর মালা দিয়ে বরণ করে অথবা কানে গুঁজে দেয় এই ফুল। এখানকার মন্দির গুলোর স্থাপত্য নেপাল বা ভারতের মন্দির গুলো মত নয়। এতে বাহারি কারুকাজ তেমন চোখে পরেনি যেমনটা অন্যান্য দেশে দেখা যায়। সরু মতন মন্দির গুলির চূড়াগুলি থাক থাক করে বানানো এবং খড়ের তৈরি। এখানকার উল্লেখযোগ্য মন্দির গুলো হল bat cave temple, Tanah lot, Besakih temple, Pura Taman Ayun temple, Holy Water Temple Bedugul temple.আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে “Tanah lot” নামক মন্দিরটি। সমুদ্রের মাঝে একটি মাত্র পাথরের উপর খাঁজ কেটে কেটে এই মন্দিরটি তৈরি। এখানকার লোকদের ধারনা এই বিশাল পাথরটি ভারত থেকে সাগর দিয়ে ভাসতে ভাসতে এখানে এসেছ। “নিরর্থ” নামক একজন মুনি এই পাথরে বসে ধ্যান করতেন এবং পরবর্তীতে একে মন্দির বানিয়ে তোলেন সমুদ্র দেবতার তুষ্টির জন্য। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ৭টি বিশাক্ত সামুদ্রিক সাপ। মন্দিরের উলটো দিকে এখনো এই সাপ দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার হিন্দুরা যেমন ভালো দেবতাদের পুজো দেন তেমনি মন্দদের ও তুষ্ট রাখেন। এখানকার পার্বণে পশু-পাখি বলি দিয়ে “বারং” নামক দুষ্টু দেবতা কে তুষ্ট রাখা হয়। ছবিতে দুর্গার পায়ের কাছে “বারং” এর অবস্থান দেখে ধরে নিলাম উপমহাদেশের “রাবন মামা” এত দূর এসে বোধ হয় এই নাম ধারন করেছেন।
বালিতে গিয়ে একবেলা “জিম্বারান” সমুদ্র সৈকতে না খেলে এই সৈকতের তাৎপর্য ও সৌন্দর্য বোঝা কঠিন। এখানে বালুর উপর সারি সারি টেবিল পাতা রয়েছে আর সামনে অনিরুদ্ধ অপার সাগর। অস্তমান সূর্যটি লাল আভা ছড়িয়ে পরিবেশটিকে আরও মোহময় করে রেখেছে যেন আমাদেরি জন্য। এই দৃশ্য দেখে হাজার বছর পার করে দেয়া যায় । কিছুক্ষণ পর যখন টেবিল গুলো তে মম্ বাতি গুলো রেখে দিয়ে গেলো আর সামনে বালিনিজ মেয়েরা ঘুরে ঘুরে তাদের লোকনৃত্য পরিবেশন করে দেখালো মনে হল যেন স্বপ্নের ভুবনে আছি। আমাদের মত ছাপোষা মানুষদের এই ক্ষুদ্র জীবনে এমন স্বপ্নিল সময় কালেভদ্রে আসে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে চলে এল রাতের খাবার, নানা পদের সামুদ্রিক মাছ। এরই মাঝে এক দল লোক গিটার আর ড্রাম বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে সবাইকে শোনাচ্ছে আর আনন্দ দিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রান ভরে উপভোগ করে নিলাম এই অপূর্ব মুহূর্তটাকে।
এখানে ঘুরে বেরানোর চমক ছিল সমুদ্র সৈকতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হটাৎ নিজেকে পাহারি রাস্তায় আবিষ্কার করা । পাশ ফিরে দেখি একটি বড় পাহাড় দেখা যাচ্ছে মনেই হচ্ছিল না যে আমরা এই কিছুক্ষণ আগে সাগরের পাশ দিয়ে এসেছি । বালির কিন্তামানি গ্রামে “মাউন্ট বাঁটুর” দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। এটি বাঁটুর লেকের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৬২-৬৪ সালে শেষ বার এতে আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ হয়েছিল। এখনো এর আসে পাশে পুরনো কালো কালো লাভা জমে আছে যা কিনা এর পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখা যায় । মাউন্ট বাঁটুরের উলটো দিকে পাহাড়ের গায়ে অনেক গুলি ঝুলন্ত বা hanging রেস্তোরাঁ তৈরি হয়েছে। হিম হিম পরিবেশে খেতে খেতে মাউন্ট বাঁটুর আর লেকের দারুন এই দৃশ্য অবলোকন করা যায় রেস্তোরাঁর ঝুলন্ত বারান্দা গুলি থেকে।
একদিন “উবুদ” নামক ছোট্ট একটি ছিমছাম শহর ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ এলো। এটি কুটা শহর থেকে ৩৫ কিলমিটার দূরে অবস্থিত নানা রকম শিল্প কর্মের জন্য বিখ্যাত একটি শহর। বিশেষ করে কাঠ আর রুপার তৈরি জিনিষের জন্য । একটি কাঠের কারখানা দেখে মনে হল গাছের কোন অংশকেই এরা ফেলনা মনে করেনা । আগা-গোঁড়া, শিকড়-ডাল পালা সব কিছু দিয়ে দারুন দারুন সব ভাস্কর্য তৈরি করে রেখেছে এখানকার শিল্পীরা । আর তাই বালিনীজ কাঠের কাজের পৃথিবী জোরা নাম। কাঠের কাজের যে শিক্ষক তাকে তারা উস্তাদ বলেই সম্মান করেন। ঊবুদ রাজার বাড়ি “ Ubud Palace” একটি অংশে এখনো রাজার বংশ পরম্পরায় বাস করেন। তাই খানিকটা ঘুরে দেখা যায় খানিকটা ঘুরে দেখায় বিধি নিষেধ আছে। উবুদ রাজ বাড়ির কাছেই রয়েছে উবুদ art market নামকরা হস্ত শিল্পের বাজার। এখানে ঝিনুক, বাটিকের কাপড়, কাঠ আর সিরামিকের নানা রকমের জিনিসে ঠাসা। বালিতে পুরুষ এবং মহিলারা এক ধরনের লুঙ্গি ব্যবহার করেন যার নাম “সারঙ”। Temple গুলোতে তে ঢোকার সময় “সারঙ” পরিধান করা বাধ্যতামূলোক বিশেষত যারা হাঁটুর উপর জামা কাপড় পরে থাকেন। এখানে একটি মন্দির আছে যার নাম “ holy water temple” এখানে পুন্য লাভের জন্য বালিনীজরা গঙ্গা স্নানের মতই স্নান করেন। উবুদ শহরটি এতই ছোট যে পায়ে হেঁটে পুরোটা শহর ঘুরে দেখে ফেলা যায়।
বালি তে আসার আগে অনেকেই বলেছিলেন বালিতে বৈচিত্রের অভাব আছে বেশী দিন ভালো লাগে না। আমরা ঈদের পর দীর্ঘ সময় বালি ঘুরবো বলে পরিকল্পনা করেছি তাই এমন মন্তব্যে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পরেছিলাম । এসে দেখলাম ভুল করি নি। যে জায়গাতে ঘুরতে যাচ্ছি যাবার আগে কিছুটা পড়ালেখা করে গুছিয়ে নিলে পৃথিবীর সব জায়গাই আনন্দময় আর বৈচিত্রে পরিপূর্ণ । শেষের দিনটি আমরা ঠিক করেছিলাম একটু অন্য রকম করে কাটাবো তাই বেছে নিলাম “Turtle Island” আর “বালি হাই ডিনার ক্রুজ”। Turtle Island হল সহজ ভাষায় কচ্ছপের হ্যাচারি । এখানে নানা বয়সী কচ্ছপের সাথে মোলাকাত এবং সাথে ছবি তোলার সুব্যবস্থা আছে । এই দ্বীপ এ যাবার সময় একটা বড় পাউরুটি ধরিয়ে দেয়া হয়। মাঝ সাগরে গিয়ে “glass bottom boat” টি খানিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে সেই সময় পানিতে পাউরুটি গুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিলে নানা রঙের মাছ এই পাউরুটি খাবার আশায় এসে নৌকার নীচে এসে ভিড় জমায় যা কিনা নৌকার নীচের গ্লাস দিয়ে দেখতে দারুন লাগে। পানিতে নেমে, পানির উপর যত প্রকারের আনন্দ করা যায় সব কিছুর ব্যবস্থা আছে এই ছোট্ট দ্বীপটিতে । banana boat riding, para-sailing, under water walking, scuba diving কি নেই।
এক বিকালে আমরা গেলাম “Bali High cruise” এ করে খানিকটা ভিন্ন স্বাদের নৌ-বিহারে ।একটি পোর্ট থেকে একটি মাঝারি আকারের একটি জাহাজ ছেড়ে দেয় যাত্রী সহ। সাগরের মাঝে গিয়ে বেশ খানিক সময় নোঙ্গর ফেলে রাখে। জাহাজের ভেতর রয়েছে রাতের খাবারের ব্যবস্থা আর সাথে গান পরিবেশন। বালিনিজ ছেলে গুলির কণ্ঠে হিন্দি গান শুনতে শুরুতে কেমন যেন লাগছিল কিন্তু পরে মন্দ লাগে নি । একে একে ওরা সেই ৮০ দশকের Labamba, Last Christmas, Eagles এর Hotel California গান গুলো গেয়ে শুনাচ্ছিল আর আমরা ফিরে গিয়েছিলাম কৈশোরের দিন গুলোয় যখন কেবল ইংরেজি গান শোনা শুরু করেছিলাম। রাতের বেলায় জাহাজ ফিরিয়ে দিয়ে গেলো আবার তীরে এবার ঘরে ফেরার পালা। ঘুরে বেড়ানোর ক্ষন গুলি অমূল্য। এক জায়গায় বার বার ফিরে আসা যায়না তাই যতক্ষণ থাকা হয় প্রান ভরে এর সৌন্দর্য , এর আনন্দ উপভোগ করে স্মৃতির মণিকোঠায় রেখে দিতে হয়। অবসরে বসে ভ্রমণের ছবি দেখে আর অনুভব করে কেটে যায় কতকটা সুখের সময়।

Nafia Farzana is a practicing psychiatrist, who works and lives in Dhaka, Bangladesh.

Photograph credit Author.


No comments:

Post a Comment